প্রাক্তন মুহতামিম

মরহুমের মোট চার জন খলিফার মধ্যে তাঁর ইন্তেকালের সময় দু’জন জীবিত ছিলেন। একজন হযরত মাওলানা আহমাদ আলী খান সাহেব, যিনি ছিলেন হযরত (রহঃ) এর প্রথম খলিফা এবং তাঁর একান্ত আস্থাভাজন। তিনি জামিয়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজীবন “আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার” অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন।

জামিয়ার প্রথম ও আজীবন প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান (রহঃ)

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

মাওলানা আহমদ আলী খান (রহঃ) ১৯০৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানাধীন হাতকবিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুজাহিদ আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।

বহু শতাব্দী পূর্বে মুসলিমরা মধ্য এশীয় অঞ্চল থেকে ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াতের পতাকা হাতে গজনী, হিরাত, কাবুল, সিন্ধু, দিল্লী, গৌড় ও কেল্লা তাজপুরের বর্ণাঢ্য দিনগুলো পেছনে ফেলে অবশেষে ষোড়শ শতকে শাসন ক্ষমতা বঞ্চিত অবস্থায় সুবে বাংলার মুলকে ভাটিতে এসে আজকের হাতকবিলায় বসতি স্থাপন করেন। মাওলানার পূর্ব পুরুষদের সাতটি গোত্র। সেই থেকেই এলাকাটির নাম করণ করা হয় হাফত কবিলা। ফার্সী ভাষায় ‘হাফত কবীলা’ কথাটির অর্থ ‘সাত গোত্র’। পরবর্তীতে হাফত শব্দটি হাত হয়ে বর্তমানে এলাকাটি ‘হাত কবিলা’ নামেই প্রসিদ্ধ।

প্রাপ্ত তথ্য ও ঐতিহাসিক সূত্রের আলোকে সময়, যুগ ও বসতকালের হিসাবে বৃহত্তর জইন শাহী পরগনার প্রাণ পুরুষ রহিম খানই মাওলানার পূর্বসূরী অগ্রপুরুষ। সাবেক মুলকে ভাটির স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব খিজির খানের পুত্র হাফত কবিলার প্রতাপশালী বাহাদুর খান ছিলেন মাওলানার প্রপিতামহ। তদীয় পুত্র লাল খান ছিলেন তৎকালীন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রসৈনিক। মাওলানার পিতা আলহাজ্জ হযরত ইবারত খান (রহঃ) ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটসহ ভাটি অঞ্চলের ইসলামী দাওয়াত, তালীম ও তাবলীগের অগ্রপথিক। এ অঞ্চলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলো অদ্যাবধি দ্বীনী তালীমের কাজ চালিয়ে আসছে। ভারতের বেনারস এলাকা থেকে আগত বিশিষ্ট বুজুর্গ, দ্বীনের দা‘য়ী হযরত হাফেজ সাহেব ছিলেন তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রমের অন্যতম সহযোগী- যাকে নিয়ে তিনি গোটা অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন এবং মানুষকে দ্বীনী শিক্ষা ও ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করে তুলতেন।

শিক্ষাঃ

মাওলানা নিজ গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বেশ কিছু দিন করিমগঞ্জে পড়াশোনা করেন। অতঃপর কিশোরগঞ্জের প্রাচীনতম উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মঙ্গলবাড়ীয়া মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ হন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনার্থে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলিকাতা আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ১৯২৭ সালে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা সমাপন করেন।

কর্মজীবনঃ

শিক্ষা সমাপনের পর ভারতের বর্ধমান জেলার বিশিষ্ট জমিদার জনাব মীর আবদুস সবূর নিজ বাড়ীর মাদরাসা পরিচালনার জন্য মাওলানাকে অনুরোধ করেন। মাওলানা সে অনুরোধে সাড়া দিয়ে বর্ধমান চলে যান। সেখান থেকে জমিদার সাহেব সপরিবারে মাওলানাকে নিয়ে হজ্জ পালন করেন।

দূর বিদেশে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করে মাওলানা তৃপ্ত ছিলেন না, তাই নিজ এলাকায় চলে আসার মনস্থ করেন। অশিক্ষা ও কুশিক্ষার আঁধারে নিমজ্জিত আপন সমাজকে ইসলামী শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত করাই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। তাই জন্মভূমি ইটনা এলাকায় চলে এসে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিছু দিন ইটনায় এবং পরে করিমগঞ্জ মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জের গুণীজনের আহবানে শহরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়বত নগর আনোয়ারুল উলূম মাদরাসায় হাদীসের দরস দিতে থাকেন এবং সুদীর্ঘ একযুগ ধরে হাদীস শিক্ষা দান করেন। তাঁর সেই সময়ের ছাত্ররা পরবর্তী সময়ে দেশ বিখ্যাত আলেম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ)- এর অন্যতম খলীফা বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও লেখক হযরত মাওলানা আমীনুল হক মাহমূদী (রহঃ) ছিলেন তাঁর সে সময়ের সুযোগ্য সাগরেদ। শিক্ষকতার পাশাপাশি তৎকালীন কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বৌলাই জমিদার বাড়ীর ধর্মীয় শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হয়ে তালীম ও দাওয়াতের কাজে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমান্বয়ে গোটা কিশোরগঞ্জ এলাকায় তাঁর দাওয়াত ও তালীমের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এ সময় আরো একবার হজ্জ পালন করেন।

মাওলানার দাওয়াতী কার্যক্রম যখন তুঙ্গে, ঠিক সেই ক্ষণে সিলেটের কৃতি সন্তান ওলীয়ে কামেল, মুজাহিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহঃ) ঈসা খাঁ মসনদে আ’লার বংশোদ্ভূত হয়বতনগরের প্রতাপশালী জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ -এর প্রচেষ্টায় এবং স্বীয় মুর্শিদ হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর পরামর্শে নরসুন্দা বিধৌত এই ছোট শহরে আগমন করেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ সাহেব প্রাজ্ঞ আলেমকে পেয়ে আনন্দে তাঁর বাড়ীর মসজিদের ইমাম ও মুয়াল্লিম নিয়োগ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তখন থেকে দুই জমিদার বাড়ীর ইমামদ্বয়ের মাঝে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিশষতঃ হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) -এর একজন খলীফাকে একান্ত কাছে পেয়ে মাওলানা তাঁর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন। অবশ্য এর আগেও তিনি মদীনা শরীফ থেকে আগত একজন বিশিষ্ট মুবাল্লিগ ও পীর হযরত মাওলানা যাইনুল আবেদীন আল-মাদানী (রহঃ)-এর সোহবতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেছেন। মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)-এর সান্নিধ্য লাভে খান সাহেবের আধ্যাত্মিক উন্নতি চরম শিখরে পৌঁছে। এ সময় তিনি কঠোর মুজাহাদায় লিপ্ত হন। সুলুকের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে একজন মুর্শিদে কামেল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং স্বীয় মুর্শিদ মাওলানা আতহার আলী (রহঃ) থেকে খেলাফত লাভে ধন্য হন।

মাওলানা আহমদ আলী খান সাহেব অত্যন্ত চরিত্রবান, বিচক্ষণ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন বলে হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)-এর প্রথম ও প্রধান খলীফা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাঁর মতো ব্যক্তির গুণাবলী লিখতে গেলে আরো একটি পান্ডুলিপির প্রয়োজন। তবে সংক্ষিপ্ত ভাবে তাঁর মধ্যে সন্নিবেশিত গুণাবলী সম্পর্কে এতটুকু বলে দেওয়াই যথেষ্ট যে, তিনি সত্যিকার অর্থে হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)-এর আশেক (প্রেমে পাগল) গোপন তথ্য ধারণকারী এবং নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। যে কারণে হযরত মাওলানা তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইমদাদিয়ার সার্বিক দায়-দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করেন। আর তিনিও তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বস্ততা, বিচক্ষণতা ও এখলাছের সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মাওলানা স্বীয় বিনয় প্রকাশার্থে মাঝে মাঝে বলতেন, আপনারা (জামিয়ার ছাত্র ও শিক্ষক) জামিয়ার যে উন্নতি দেখছেন, এটা খান সাহেবের বুযুর্গীর বরকত।

জামিয়ার প্রতিষ্ঠলগ্ন থেকে মাওলানা আহমদ আলী খান (রহঃ) -এর প্রিন্সিপাল হিসাবে সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জীবনের সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছর এই গুরু দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধ্যক্ষ জীবনে প্রতিষ্ঠাতার নিরলস প্রচেষ্টা ও পরিচালকের নিষ্ঠাপূর্ণ কর্ম দক্ষতায় জামিয়ার সার্বিক উন্নতি সাধিত হয়। এক কথায় তাঁর অধ্যক্ষ জীবনের চল্লিশটি বছরকে জামিয়ার স্বর্ণযুগ বলা হয়। আধ্যাত্মিক জগতে উচ্চাসনে সমাসীন মাওলানা আহমদ আলী খান (রহঃ) ছিলেন অন্যতম মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত ব্যক্তিত্ব। অসংখ্য ভক্ত ও মুরীদ তাঁদের জটিল সব সমস্যায় তাঁর দোয়া নিয়ে উপকৃত হয়েছেন, তাঁর একটু ফুঁ বা একটা তাবিজের জন্য ভোরবেলা সমবেত হতেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ভক্ত অনুরক্তগণ। মানুষ মুরীদ ভক্তদের মত তাঁর অসংখ্য জিন মুরীদ শাগরেদ ছিল, যারা অধিকাংশ সময় গভীর রাতে এসে তাঁর তা’লীম ও তাযকিয়ার মজলিসে শামিল হতো এবং জমাতের সাথে তাঁর পেছনে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতো। তাই দেখা গেছে, তিনি সাধরণতঃ একা এক ঘরে থাকতেন। আর রাতভর জিনদের উদ্দেশে তাঁর ওয়াজ নসীহত ও শাসনের বাণী শোনা যেত বরাবরই।

মাওলানার জীবনে ছিল দু’টি অবস্থা। তিনি ক’মাস থাকতেন অত্যন্ত দুর্বল, চিন্তিত, পরিশ্রান্ত ও বিষণ্ন। কথাবার্তা, চলাফেরা, লেনদেন সবকিছুতেই কেমন যেন দুর্বলতা ভাব। কিন্তু ঠিক ক’মাস পরই দেখা যেত তাঁর অন্য এক রূপ। হাসি- খুশি, আনন্দ উল্লাসে উচ্ছসিত তাঁর জীবনাচার। বিভিন্ন নির্মাণ ও সংস্কার কাজে ব্যস্ত। এ ছাড়াও কথাবার্তা, উঠাবসা, চলাফেরা ও লেনদেন সবকিছুতেই প্রবল সাহস ও মনোবলে উদ্যমী। এ যেন অন্য একজন যার সাথে পূর্বের জনের সামান্যও মিল নেই। আধ্যাত্মিকতার পরিভাষায় এই দুই অবস্থার নাম যথাক্রমে হালতে কব্জ ও হালতে বস্ত। তাঁর জীবন ছিল আল্লাহর একজন আদর্শ ওলীর জীবন। যারা তাঁকে দেখেছেন তারাই কেবল তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন। কিশোরগঞ্জবাসী একবাক্যে ‘খান সাহেব হুজুর’ বলে তাঁকে জানতেন। তিনি মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)-এর প্রধান সহযোগী হিসাবে আল- জামিয়াতুল ইমদাদিয়া ও ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদ নির্মাণে সীমাহীন ত্যাগ ও তিতীক্ষার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর ন্যায় নিষ্ঠা, আদর্শ, চরিত্র ও ভাবগাম্ভীর্য এলাকার সকল শ্রেণীর মানুষের উপর এক অলৌকিক প্রভাব ফেলে রেখেছিল, যার কারণে এলাকাবাসী সর্বদা বিনম্রচিত্তে প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রদর্শন করেছে।

১৯৭৬ সালে মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)-এর ইন্তেকালের পর ৬টি বছর তিনি সহিষ্ণুতার পাহাড় স্বরূপ এলাকার মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান করে ১৯৮২ সালের ১৩ই এপ্রিল মঙ্গলবার রাত ১১-৫৫ মিনিটে জামিয়া রোডস্থ নিজ বাস ভবন নূর মঞ্জিলে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুপূর্ব ৬ঘন্টা সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় অনবরত তাঁর মুখে আল্লাহ্ আল্লাহ যিকির উচ্চারিত হচ্ছিল, যা উপস্থিত মেডিক্যাল বোর্ডসহ সকল দর্শনার্থীকে অবাক করছিল। আল্লাহ, আল্লাহ করাই ছিল যার জীবনের সাধনা আল্লাহই ছিল যার একমাত্র অভিভাবক, তাঁর যবান থেকে অজ্ঞান অবস্থায় সেই মধুর নাম উচ্চারিত হওয়াইতো স্বাভাবিক। তাঁর প্রিয়জনকে ডেকে ডেকেই তাঁর সান্নিধ্যে চলে গেলেন আল্লাহর এই প্রিয়জন। আল্লাহ পাক এই মহান মনীষীকে জান্নতের উচ্চাসন দান করুন এবং আমাদেরকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

পরলোকগমনঃ

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি তাঁর একমাত্র সন্তান প্রখ্যাত আলেম, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আতাউর রহমান খান ও নাতী-নাতনী সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ ও গুণগ্রাহী রেখে যান।

জামিয়ার দ্বিতীয় প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কুদ্দুস এম, এ

১৯৫৭ সালে জামিয়ার বিশেষ প্রয়োজনে জামিয়ার পরিচালনায় পরিবর্তন আনয়ন করে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে জামিয়ার প্রিন্সিপাল করা হয়। তাঁর নাম এ, এইচ, এম, এ কুদ্দুছ। তিনি একজন আলেম হওয়ার পাশাপাশি জেনারেল লাইনেও সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি বি, এ, অনার্স এম, এ, -এবং এফ, এম ডিগ্রিধারী ছিলেন।

জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহঃ)- এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম পার্টির বেশ কজন সদস্য ১৯৫৪ সনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এম,এন,এ, ও এম, পি, এ নির্বাচিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এবং তিনি সংসদীয় দলের প্রধান হওয়ার দরুন সারা পাকিস্তানের সকল মন্ত্রী, এম,পি, এ ও সচিব এমনকি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতার মাধ্যমে জামিয়া ইমদাদিয়ার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাছাড়া মাওলানা (রহঃ) নেযামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে ছিলেন সারা পাকিস্তানে পরিচিত একজন প্রভাবশালী জাতীয় নেতা। কাজেই সরকারী আমলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত ছুটে আসেন তাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া এক নজর দেখার বিরল সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে। তাদের সাথে খোলাখুলি ভাবে মতবিনিময় করা এবং জামিয়ার পরিচিতি ও প্রয়োজন লিখিত ভাবে তাদের নিকট তুলে ধরার স্বার্থে এ উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে ১৯৫৭ সালের শুরুতে জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর পূর্ণ ৫৭ সালটি তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত থেকে যে উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অত্যন্ত সফলতার সাথে তা পালন করেন। তাঁর আমলে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় লিখিত জামিয়ার ১৯৫৭ সালের বার্ষিক রিপোর্টটি উপরোক্ত দাবীর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। স্বাধীনতা উত্তর বিপর্যয়কালে জামিয়ার রেকর্ডপত্র খোয়া যাওয়ার কারণে এর অধিক তাঁর কোন পরিচিতি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

জামিয়ার তৃতীয় প্রিন্সিপাল আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

জন্ম ও পিতৃ পরিচয়ঃ

১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় কিশোরগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদী মসজিদ সংলগ্ন বাসায় জন্মগ্রহণ করেন পিতা ছিলেন হাকিমুল উম্মত থানবী রহ. বিশিষ্ট খলিফা ও জগতবিখ্যাত আলেম এবং ইসলামী রাজনীতির পুরোধা মুজাহিদে মিল্লাত শাইখুল ইসলাম আতহার আলী রহ.। যিনি কিনা আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং আধুনিক কিশোরগঞ্জের রূপকার।

প্রাথমিক শিক্ষাঃ

পড়ালেখার শুরু মরহুমের পিতার কাছেই। তাছাড়া পিতার বিশিষ্ট খলিফা কারী হযরত মাওলানা নিছার আলী রহ. এর নিকট প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়। প্রাথমিক বাংলা ও ইংরেজী ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা লাভ করেন সুপণ্ডিত জনাব মাষ্টার আব্দুর রশিদ সাহেবের নিকট। এর পর ১৯৬০ সনে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় কালামে পাক হেফজ শুরু করেন। মাত্র দেড় বছর সময়ে হাফেয মাওলানা নূরুল ইসলাম রহ. তত্ত্বাবধানে হিফয সমাপ্ত করেন।

মাধ্যমিক শিক্ষাঃ

১৯৬২ সালে পিতা মরহুমের প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতেই তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মাওলানা সাইয়্যিদ আবদুল আহাদ কাসেমী রহ. সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তদানিন্তন সময়ে যিনি ছিলেন ইসলামী উলূমের সর্ব বিষয়ে সুপন্ডিত, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক। তাঁর স্বযত্ন তত্ত্বাবধানে তিনি মাত্র এক বছরে একাধিক জামাত (ক্লাশ) কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হন। তাছাড়া প্রখর মেধা, ধী-শক্তি এবং বিস্ময়কর স্মরণ শক্তির অধিকারী হওয়ায় ১৯৬৪ সালে মাত্র দু’বছরে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

উচ্চ শিক্ষাঃ

১৯৬৪ সালে পিতা মরহুমের নির্দেশে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে পারি জমান। সেখানকার বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ ‘জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া, নিউটাউন’- এ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। সেখানে হাদীস ও তাফসিরে বিশেষ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে বেফাকুল মাদারিস (মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, পাকিস্তান) এর অধীনে গৃহীত দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাঁর হাদীসের বিশিষ্ট উস্তাদ হচ্ছেন যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আন্তর্জাতিক ইলমী ব্যক্তিত্ব আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ., আল্লামা ওয়ালী হাসান টুংকি রহ. ও হযরত মাওলানা ইদরিস মীরাঠী রহ প্রমূখ। ইলমে তাফসীরে তাঁর অন্যতম উস্তাদ হলেন হাফিজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী রহ.। উল্লেখ্য যে, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তথায় প্রেরিত ৪ জন খ্যাতিসম্পন্ন উস্তাদের কাছে তিনি ১৯৬৬ সালে আরবী সাহিত্য ও তাজবীদুল কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। ইলমে ক্বেরাত ও তাজবীদে তাঁর উস্তাদ হলেন ক্বারী আতা সোলাইমান রিযক আল মিসরী ও উস্তাদ ইবরাহীম আব্দুল্লাহ। এভাবে তিনি শিক্ষা জীবনের সকল স্তরের সবকটি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে স্বক্ষম হন।

আধ্যাতিক সাধনাঃ

আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে বাইয়াত হন হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ. এর বিশিষ্ট খলীফা মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ্ আবরারুল হক সাহেব রহ. এর হাতে। দীর্ঘ মুজাহাদার পর ২০০৪ সালে তিনি তাঁর নিকট থেকে খেলাফত লাভ করেন। এছাড়াও আরো চারজন বিশিষ্ট বুযুর্গের নিকট থেকে ইতোপূর্বেই তিনি খেলাফত লাভে ধন্য হন। তাঁরা হলেন-
১) হযরত জাফর আহমদ উসমানী রহ. এর খলীফা খাজা শামছুল হক রহ. কাটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ ।
২) হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান রহ. সিলেট।
৩) হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. মোমেনশাহী
৪) হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা এহসানুল হক সন্দ্বিপী রহ. চট্টগ্রাম ।

কর্ম জীবনঃ

১৯৬৮ সনে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের উচ্চতর কিতাব অধ্যাপনা করেন স্বাধীনতা উত্তর দুর্যোগকালে অন্যান্য মাদরাসার মতো জামিয়াও বন্ধ হয়ে গেলে কিছুদিন তাঁর অধ্যাপনার কাজ বন্ধ থাকে। এ সময় তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত পালনের লক্ষ্যে কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান। ১৯৭৫-৭৬ সালে জামিয় ইসলামিয়া মোমেনশাহীতে অত্যন্ত সুনামের সাথে মুহাদ্দিস ও নাযেমে তালীমাত (শিক্ষা সচিব) এর দায়িত্ব পালন করেন। দুর্যোগ উত্তর জামিয়া পুনরুদ্ধার হলে তিনি ১৩/১২/১৯৭৭ তারিখে আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ০৫/০৩/১৯৭৯ তারিখে তিনি অত্র প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। প্রিন্সিপাল মাওলানা আহমদ আলী খাঁন রহ. স্বাস্থ্যগত কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করলে জামিয়ার স্বার্থে তাঁকে প্রিন্সিপাল পদে বহাল রেখে তাঁর যাবতীয় দায়িত্ব ও অধিকার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ সাহেবের উপর ন্যস্ত করা হয়। কাজেই যে তারিখে তিনি ভাইস-প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন ঐ তারিখ হতেই মজলিসে শুরা কর্তৃক প্রিন্সিপালের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ০১/০১/১৯৮৩ তারিখে তিনি প্রিন্সিপাল পদে উন্নীত হয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ গুরু দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন।

অন্যান্য দায়িত্বসমূঃ

  • নূরুল উলূম কুলিয়ারচর মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল।
  • জামিয়া ইসলামিয়া গাইলকাটা মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল।
  • পটিয়া, ভাস্করখিলা, আব্দুল্লাহপুর, বারুইগ্রাম, ইসলামপুর ও সুরাটি কওমী মাদরাসাসহ অনেক মাদরাসার পরিচালনা কমিটি ও মজলিসে শুরার সভাপতি বা সদস্য হিসেবে একজন বিশিষ্ট মুরুব্বির দায়িত্ব পালন করে ছিলেন
  • বেফাকুল মাদারিস কওমিয়া বাংলাদেশ-এর সিনিয়র সহ সভাপতি
  • হাইয়াতুল উলিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সদস্য
  • তানযিমুল মাদারিস কওমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
  • কিশোরগঞ্জ ইমাম-উলামা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
  • দাওয়াতুল হক কিশোরগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
  • আল-আতহার সাহিত্য পাঠাগার এর পৃষ্টপোষক ছিলেন ।

অবদানঃ

প্রিন্সিপাল জীবনে জামিয়ার উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য তিনি অনেক অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত ছাত্র-শিক্ষকদের সার্বিক সুবিধার্থে তাঁর পদক্ষেপগুলো চিরস্মরণীয়। সার্বিক দূরাবস্থা দূরিকরণে তিনি স্থান সংকুলানের অভাব দূরিকরণ, প্রতিবছরেই বেশী সংখ্যক নতুন ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ প্রদান, ছাত্রাবাস বর্ধিতকরণ, পর্যাপ্ত বাথরুম, টয়লেট নির্মাণ ও টিউবওয়েল স্থাপনের ব্যবস্থা করেন । নতুন সাততলা ইমারতটি জামিয়ার সার্বিক উন্নতিকল্পে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্ঠা এবং আল্লাহ ভরসার অনন্য নজির । জামিয়ার আধুনিকায়ন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি পুরো মাদরাসাকেই সিসি’র আওতাভূক্ত করেন এবং সাততলা ভবনে লিফটের ব্যবস্থাও করেন।

রাজনীতিঃ

তাঁর পিতা মরহুম ছিলেন বাংলার ইসলামী রাজনীতির পুরোধা। উপমহাদেশের ইসলামী রাজনীতির স্থপতি। জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি রাজনীতির ময়দানে ব্যয় করেছেন। কিন্তু জীবনের শেষবেলায় প্রিয় পুত্রকে অসিয়ত করে যান ‘বেটা, আমার অসিয়ত “তুমি কখনো দলীয় রাজনীতিতে অংশ নিবে না”। কারণ আমি দলীয় রাজনীতিতে আর অংশ নিব না। আমি দলিয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। এখানে নিজের লোকেরাই গাদ্দারী ও বিশ্বাসঘাতকতা করে । পিতার এ অসিয়ত মেনে তিনি কখনো প্রচলিত দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেননি। তবে ইসলামী রাজনীতির মূলধারা থেকে একদম দূরে সরে যাননি। দেশ ও জাতির রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে বয়ান ও খতুবার মাধ্যমে অমূল্য দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ওপর যে কোনো আঘাতের প্রতিবাদে সবার আগে গর্জে ওঠেন। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, আফগানিস্তান, কাশ্মির, ইরাক বসনিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, উইঘুর ও রোহিঙ্গা মজলুম মুসলিম জাতির ওপর হামলা ও ধ্বংষযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, নাস্তিক-মুরতাদ, কাদিয়ানি অপপ্রচার, মদ, জুয়া হাউজি, যাত্রা ও নানা অসামাজিক কাজ বন্ধে অত্যন্ত নির্ভিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি উদ্ভুত তাবলিগি সংকট ও ফেরকায়ে সাদিয়ানিদের তৈরীকৃত সমস্যার বিরুদ্ধে প্রবল নেতৃত্বে এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানান সংকট-সমস্যার রাহনুমায়ী বয়ান, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন

অনন্য প্রতিভাঃ

আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দান করেছিলেন এক অনন্য প্রতিভা। পিতার মতোই তিনি অগণিত গুণের অধিকারী ছিলেন। দেখতে বড়ো সাদাসিধে অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। স্বল্পভাষী, গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দূর থেকে দেখলে ভয় ভয় লাগতো। কাছে গেলে মখমলের মতো নরম ছিলেন। খুবই দিলখোলা আর প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালক। দরসের মসনদে আদর্শ উস্তাদ। তরবিয়তের মজলিসে তালিমি মুরুব্বি। তাঁর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ছিলেন একজন বরেণ্য ওয়ায়েজ বিদগ্ধ আলোচক। খুবই হৃদয়গ্রাহী ছিল তাঁর বয়ান ও বক্তৃতা। মধুর কন্ঠস্বর, অনুপম বাচনভঙ্গি, যথাযথ শব্দচয়ন, অতুলনীয় উপস্থাপনা এবং স্থানকাল পাত্র ভেদে কথা বলার বিশেষ যোগ্যতায় তিনি ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ ছিলেন। বাংলা, আরবী, উর্দু, ফার্সী ও ইংরেজী প্রভৃতি ভাষায় অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই অসম্ভব মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন। বড় হয়ে তিনি হয়েছেন ফুল-ফলে ভরপুর সুশীতল ছায়াময় এক মহীরুহ। যার নিচে বেড়ে উঠছে সম্ভাবনার হাজারো ব্যক্তিত্ব।

রচনাবলীঃ

তাঁর নিজস্ব রচনাবলী-

  • কিছু বিক্ষিপ্ত কথা
  • খুতবাতে শায়খে আনোয়ার শাহ্

তার তত্ত্বাবধান মালিকানায় প্রকাশিত গ্রন্থাদি-

  • হায়াতে আতহার
  • আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান
  • স্মৃতির আয়নায় দেখা প্রিয়মুখ
  • তথাকথিত আহলে হাদিস ফিতনার জবাব
  • মকালীন সমস্যাবলির শরয়ী সমাধান

দেশভ্রমণঃ

তিনি দু’বার হজ্ব পালন করেন। প্রথমবার ১৯৭৬ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০ সালে। ১৯৮১ সালে স্টাডি ট্যুর হিসেবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর সফর করেন। ১৯৮৭ সালে ইরাকের তখনকার ধর্মমন্ত্রীর দাওয়াতে ইরাক সফর করেন। ১৯৯৪ সালে ভারত ২০০০ সালে আরব আমিরাত ও ২০০৩ সালে পাকিস্তান সফর করেন। এছাড়াও টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গোটা বাংলায় প্রায় সময়ই ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় কাজে দাওয়াত, মাহফিল এবং প্রোগ্রাম মিটিংয়ে যাওয়া-আসা করেছেন।

পরলোকগমনঃ

৩ জমাদিউস সানী ১৪৪১ হিজরী মোতাবেক ২৯ জানুয়ারী ২০২০ খ্রিস্টাব্দ ১৬ মাঘ ১৪২৬ বাংলা রোজ বুধবার বিকাল ৫ ঘটিকায় ৭৩ বছর বয়সে জাতীর কান্ডারী, এ পৃথিবীর মায়াবী বন্ধন ছিন্ন করে মহাপ্রভুর পরম সন্নিধ্যে চির প্রস্থান করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়াস্থ বাগে জান্নাত সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ইন্তেকালের সময় মরহুম তাঁর এক পত্নী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে, নাতি-নাতনী অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত অনুরক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মরহুম হযরতের কনিষ্ট ভাই মাওলানা শাব্বির আহমাদ রশিদ সাহেব আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মুহতামিম/মহাপরিচালক এবং শহীদী মসজিদের মুতাওয়াল্লীর গুরু দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে যাচ্ছেন।

রচনায়

সৈয়দ জিয়াউর রহমান ফাহিম

আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ।